ছোটোবেলার পেনসিলের স্মৃতি এবং পেনসিলের কিছু গল্প
Childhood memory with pencils and story of pencils
(Image source: Republic World) |
ছোটোবেলায় হাতে খড়ির পর স্লেটে আমরা লিখতে শুরু করি। তারপর যখন কাগজে আমরা লিখতে শুরু করি তখন প্রথম পেন্সিল হাতে পাই। এরপর অন্তত সাত আট বছর পর্যন্ত পেনসিল, রবার, পেনসিল কাটার Sharpener আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকে। পেনসিলের সঙ্গে ছোটোবেলার অনেক স্মৃতিই জড়িয়ে থাকে।
আপনাদের মনে থাকতে পারে ছোটোবেলায় কোন পেনসিলগুলো ব্যবহার করতেন। নটরাজ (Nataraj), অপ্সরা (Apsara), ক্যামলিন (Camlin), ডোমস (Dom’s) – এই পেনসিলগুলোই আমরা ব্যবহার করতাম।
(Image source: Pinterest) |
সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পেনসিল ছিল নটরাজ। সেই লাল কালো রঙের পেনসিল তার উপর লেখা Nataraj ভারতের খুব পুরোনো একটা পেনসিল। নটরাজ থেকে দামে একটু বেশি অপ্সরা পেনসিলে ছিল একটু সৌখিনতার ছোঁয়া। অনেক সময় বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো নটরাজ না অপ্সরা কোনটি সেরা এই বিষয়ে। প্রায় সবাই মনে করতাম নটরাজ এবং অপ্সরা এই দুটি পেনসিল প্রস্তুতকারী সংস্থা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি। আসলে নটরাজ এবং অপ্সরা এই পেনসিল দুটি একই কোম্পানির দুটি ভিন্ন ব্র্যান্ড। হ্যাঁ, এই দুটি পেন্সিল হিন্দুস্থান পেনসিলস্ প্রাইভেট লিমিটেডের (Hindustan Pencils Pvt. Ltd.) দুটি Brand.
নটরাজ এবং অপ্সরা এই পেনসিল দুটি Hindustan Pencils Pvt. Ltd.-এর দুটি ভিন্ন ব্র্যান্ড |
ভারতের পেনসিল কোম্পানি
স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতে পেনসিল আমদানি করা হতো বিদেশ থেকে। কোনো স্থানীয় স্বদেশী ভারতীয় পেনসিল কোম্পানি ছিল না। মূলত জার্মানি, জাপান থেকে ভারতের বাজারে পেনসিল আনা হতো। ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে জার্মানি, জাপান থেকে ভারতে পেনসিল আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই সময় ভারতের কলকাতা, মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই), বোম্বায়ে (অধুনা মুম্বাই) ভারতীয়দের চেষ্টায় পেনসিল ফ্যাক্টরি তৈরি হয়। ভারতে তৈরি পেনসিল বিদেশি পেনসিলের তুলনায় গুণগত মানে খারাপ ছিল কারণ বিদেশি উন্নত প্রযুক্তি ভারতের পেনসিল কারখানায় ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর আবার বিদেশ থেকে ভারতে পেনসিল আসতে শুরু করে। আগেই বলা হয়েছে ভারতে তৈরি পেনসিল বিদেশি পেনসিলের তুলনায় গুণগত মানে ভালো ছিল না, এজন্য বিদেশে তৈরি পেনসিল পুনরায় ভারতের পেনসিল বাজারে জাঁকিয়ে বসে। ব্যাবসায় টিকে থাকার জন্য এই সময় ভারতীয় পেনসিল কোম্পানিগুলো ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল বিদেশ থেকে ভারতে পেনসিল আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় পেনসিল কোম্পানিগুলোর দাবি মানতে অস্বীকার করে। এর ফলে বিদেশি পেনসিলের কাছে প্রতিযোগিতায় পরাস্ত হয়ে ভারতের বেশিরভাগ পেনসিল কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
(Image source: livemint.com) |
স্বাধীনতার পর ভারত সরকার বিদেশি পেনসিলের আমদানি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করলেও ভারতের পেনসিল বাজারে তখনও বিদেশি পেনসিলের আধিপত্য ছিল। বি. জে. সাঙ্গভি (বাবুভাই নামে পরিচিত) (BJ Sanghvi, known as Babubhai), রামনাথ মেহেরা (Ramnath Mehra), মনসুকানি (Mansookani) – এই তিন বন্ধু জার্মানি গিয়ে পেনসিল তৈরির পদ্ধতি শিখে আসেন। ১৯৫৮ সালে তিন বন্ধুর প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে হিন্দুস্থান পেনসিলস্ কোম্পানি। সেই বছর হিন্দুস্থান পেনসিলস্ প্রথম বাজারে আনে নটরাজ পেনসিল। উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়া দেশীয় পেনসিল ভারতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নটরাজ পেনসিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশীয় ও বিদেশী কোম্পানির পেনসিলগুলো পিছিয়ে পড়ে। নটরাজ পেনসিলের ট্যাগলাইন (tagline) ছিল ‘फिर से चैंपियन नटराज’ (Phir se champion Nataraj অর্থাৎ আবার চ্যাম্পিয়ন নটরাজ)।
(Image source: Pinterest) |
১৯৭০ সালে হিন্দুস্থান পেনসিলস্ বাজারে নিয়ে আসে অপ্সরা পেনসিল। সেই সময় অপ্সরা পেনসিল প্রধানত ছবি আঁকার জন্য ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে অপ্সরা পেনসিল লেখার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়। অপ্সরা পেনসিলের ট্যাগলাইন ছিল ‘Five marks extra’ (অতিরিক্ত পাঁচ নম্বর)। নটরাজ এবং অপ্সরা পেনসিল ভারতের পেনসিল বাজার দখল করে।
(Image source: Facebook) |
বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে তৈরি হয়েছিল Camlin. সেই সময় ক্যামলিন তৈরি করতো ফাউন্টেন পেন, ব্ল্যাকবোর্ডের চক। ক্যামলিনের Horse ব্র্যান্ডের কালি জনপ্রিয় ছিল। ১৯৭০ সাল থেকে ক্যামলিন ছবিতে রং করার জন্য রঙিন পেনসিল তৈরি করতে শুরু করে। ২০১২ জাপানি মাল্টিন্যাশনাল কোকুও কোম্পানি ক্যামলিনের বড়ো অংশ কিনে নেবার পর ক্যামলিনের নাম হয়েছে কোকুও ক্যামলিন লিমিটেড (Kokuyo Camlin Ltd.)।
(image source: IndiaMart) |
এবার একটু দেখে নেওয়া যাক কীভাবে পেনসিল তৈরি করা হয়।
পেনসিল তৈরির পদ্ধতি
(১) পেনসিলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ পেনসিলের সিস যা তৈরি হয় গ্ৰাফাইট থেকে। গ্ৰাফাইট ও কাদামাটির চূর্ণকে জলে মিশিয়ে কিছুটা ঘন তরল করার পর সেই তরলকে সরু নলের মধ্যে রাখা হয়। তরলটি শুকিয়ে গেলে পাতলা রডের মতো সিস তৈরি হয়। এরপর রডগুলিকে উত্তপ্ত করা হয় এবং পেনসিলের আকারে কাটা হয়।
Inside view of a pencil factory in Pulwama (Image source: groundreport.in) |
(২) সিডার গাছের কাঠ চৌকাকৃতি কেটে স্ল্যাট করা হয়। স্ল্যাটগুলিকে কনভেয়ার বেল্টে রাখা হয়। স্ল্যাটের এক দিকে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর অর্ধবৃত্তাকার খাঁজ কাটা হয়। স্ল্যাটে আঠা লাগিয়ে খাজগুলিতে গ্ৰাফাইটের সিস বসানো হয়।
(Image source: blog.pencils.com) |
(৩) এবার এই স্ল্যাটের উপর একই খাঁজযুক্ত স্ল্যাট যুক্ত করা হয়। এভাবে একটি স্যান্ডউইচ করা হয়। প্রতিটি স্যান্ডউইচকে হাইড্রোলিক প্রেসের সাহায্যে চাপ দেওয়া হয়। ফলে আঠার মাধ্যমে দুটি স্ল্যাট ভালো করে যুক্ত হয়ে যায়।
(Image source: blog.pencils.com) |
(৪) এরপর প্রতিটি সিসের অবস্থান অনুযায়ী গোলাকার বা ষড়ভুজাকার অথবা ত্রিকোণাকার পেনসিল কাটা হয়। এরপর পেনসিলের উপর রঙ করে পিছনের অংশে আঠার সাহায্যে কেস বসানো হয়। এভাবে পেনসিল তৈরি করে কয়েকটি পেনসিল একত্রিত করে প্যাকেটিং করে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।
(Image source: madehow.com) |
আরও কিছু অতিরিক্ত তথ্য জানা যাক
- পেনসিলের একদম আদি অবস্থায় গ্ৰাফাইটের সিসের উপর কাপড় জড়িয়ে ধরা হতো। পরবর্তীতে কাপড়ের বদলে কাঠ ব্যবহার শুরু হয়।
- পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পেনসিল তৈরি হয় চীন, ব্রাজিলে। ভারতের হিন্দুস্থান পেনসিলস্ বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশটি দেশে পেনসিল রপ্তানি করে।
- ভারতের কাশ্মীরের পুলওয়ামা (Pulwama) জেলার ওউখো (Oukhoo) গ্ৰামে সবচেয়ে বেশি পেনসিল স্ল্যাট তৈরি হয়। ভারতের পেনসিল ফ্যাক্টরির ৯০ শতাংশ স্ল্যাটের চাহিদা ওউখো গ্ৰাম থেকে মেটানো হয়। এজন্য ওউখো (Oukhoo) গ্ৰামকে ‘পেনসিল গ্ৰাম’ (‘Pencil Village’) বলা হয়।
(Image source: Facebook) |
বর্তমানে মোবাইল, কম্পিউটারে সব টাইপ করা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির সামনে পেনসিল শিল্প একটু দুর্বল হলেও পেনসিল, রবারের গুরুত্ব কমেনি। বিশেষত বাচ্চাদের জন্য পেনসিল আজও একই আছে।