ইনস্টাগ্রামে ছবি দেখে হিমালয়ে নতুন সাপের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা
Scientists found a new snake species in the Himalayas on instagram
আমাদের পৃথিবী জীব বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। পৃথিবীতে কতো প্রজাতির জীব রয়েছে তা ভাবলেই অবাক হতে হয়। পৃথিবীতে প্রায় কতো প্রকারের জীব রয়েছে তার সঠিক সংখ্যাগত তথ্য পাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। IUCN-এর (International Union for Conservation of Nature) ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীতে ১.৫ মিলিয়ন (১৫ লক্ষ) উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ২০ মিলিয়ন থেকে ৭০ মিলিয়ন বিভিন্ন জীবের প্রজাতি রয়েছে। বিজ্ঞানী রবার্ট মে-এর (Robert May) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হিসাবের অনুমান অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ৭ মিলিয়ন (৭০ লক্ষ) প্রজাতির জীব রয়েছে। তাঁর হিসাবকে সঠিক ধরলে এখান পর্যন্ত মাত্র ২২ শতাংশ জীব আবিষ্কৃত হয়েছে। এখনো ৭৮% জীব প্রজাতি মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়নি। জীববিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত নতুন জীবের সন্ধান করে চলেছেন। প্রায়শই নতুন কোনো জীব আবিষ্কৃত হয়, কখনো কোনো বিলুপ্ত প্রজাতির নমুনা পাওয়া যায়, আবার কোথাও পরিচিত জীবের নতুন কোনো প্রজাতির খোঁজ পাওয়া যায়। এমনি এক নতুন প্রজাতির সাপের সন্ধান পাওয়া গেছে। কীভাবে নতুন প্রজাতির সাপটির সন্ধান পাওয়া গেছে তা জানলে অবাক হবেন।
Postgraduate student Virendar Bhardwaj had uploaded this photo of a snake in his backyard in Himachal Pradesh. [Image credit: Virendar Bhardwaj via Instagram] |
বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মতো ভারতেও প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউ এসেছিল ২০২০ সালে। করোনা ভাইরাস (corona virus) সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকায় মার্চ মাসের শেষে ভারতে লকডাউন শুরু হয়েছিল। সমস্ত স্কুল, কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের উত্তরে অবস্থিত অঙ্গরাজ্য হিমাচল প্রদেশে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত চাম্বা। পশু-পাখি, জীব-জন্তু বিষয়ে আগ্ৰহী বিরেন্দ্র ভারদ্বাজ পাঞ্জাবের অমৃতসরের গুরু নানক দেব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। লকডাউনের সময় সে চাম্বায় নিজের বাড়িতে ছিল। বাড়ির পিছনের দিকে ফাঁকা জায়গায় বিরেন্দ্র বিভিন্ন প্রাণী – সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি এবং বিভিন্ন পতঙ্গের ছবি তুলতো। এই ছবিগুলো জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ইনস্টাগ্রামে আপলোড করতো নিজের অভিজ্ঞতা বহু মানুষকে জানানোর জন্য এবং ছবিগুলোকে অনলাইনে ইন্টারনেটে সংগ্ৰহ করে রাখার জন্য।
বিরেন্দ্র ভারদ্বাজ ৫ জুন ২০২০, শুক্রবার, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে একটি সাপের ছবি পোস্ট করেছিল ইনস্টাগ্রামে। ইনস্টাগ্রামের অন্য এক ইউজার (user) জীশান এ. মির্জা (Zeeshan A Mirza) এই ছবিটি লক্ষ্য করেছিলেন। বিজ্ঞানী জীশান এ. মির্জা ভারতের কর্নাটক রাজ্যের রাজধানী ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এ (National Centre for Biological Sciences, Bengaluru) কর্মরত একজন হারপেটোলজিস্ট (Herpetologist অর্থাৎ যিনি সরীসৃপ, উভচর প্রাণী সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ)। সাপের ছবিটি দেখে বিজ্ঞানী মির্জার সাপটিকে কিছুটা অপরিচিত মনে হয়েছিল। তিনি নির্দিষ্ট করে বুঝতে পারছিলেন না যে এটি আসলে কোন সাপ। সাপটিকে মনে হচ্ছিল কুকরী গোত্রের। এই সাপের বাঁকানো দাঁত থাকে, যা অনেকটা কুকরী-র মতো দেখতে। হিন্দিতে কুকরী (खुकुरी) বলতে এক বিশেষ প্রকার বাঁকানো ধারওয়ালা খড়্গ-কে বোঝায়। এই কুকরী খড়্গ নেপালের গোর্খা, কীরাতি মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে। দাঁতের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য এই গোত্রের সাপেগুলিকে কুকরী বা নেপালী ড্যাগার (Dagger অর্থে চাকু বা খড়্গ) বলা হয়। কিন্তু সাপটি যেমন দেখতে সেই রকম কুকরী সাপ চাম্বা অঞ্চলে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানী মির্জার সন্দেহ হয় এটি নতুন কোনো সাপ নয় তো।
বিজ্ঞানী মির্জা সেই সাপটি সম্পর্কে ভালো করে জানতে চাইলেন। এজন্য একটি গবেষক দল গঠন করা হয়। বিজ্ঞানী মির্জা ছাড়াও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকারী এই টিমে ছিলেন বীর নার্মাদ দক্ষিণ গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের (Veer Narmad South Gujarat University) গবেষক হর্ষিল প্যাটেল (Harshil Patel)। হর্ষিল প্যাটেল বায়োসায়েন্স (BioScience), অভিব্যক্তি সম্পর্কিত জীববিদ্যা (Evolutionary Biology), গুজরাটের সরীসৃপ প্রাণী সম্পর্কে রিসার্চ করেন। শুধুমাত্র ছবি দেখে সাপটিকে সনাক্তকরণ করে সঠিক ভাবে বলা যাবে না যে এটি কোনো নতুন আবিষ্কৃত সাপ। বিজ্ঞানীদের দলটি যোগাযোগ করলেন বিরেন্দ্র ভারদ্বাজের সঙ্গে। বিরেন্দ্র বিজ্ঞানীদের তদন্তকারী দলটিকে আরও দুটি সেই একই রকম সাপ খুঁজে দিতে সক্ষম হয়। এর পর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাপের সনাক্তকরণ শুরু হয়।
কোভিড-১৯ (Covid-19) এর জন্য বহু ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল। গবেষকদের পক্ষে গবেষণাগার, মিউজিয়াম যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার কারণে গবেষণার কাজ ধীরে এগোতে থাকে। ২০২১ সালের প্রথমদিকে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল হয়। ল্যাবরেটরি খোলা হলে জৈব আনবিক (molecular data) গঠনের পরীক্ষা করা হয়। এর রিপোর্ট থেকে জানা যায় সাপটি সাধারণ কুকরী প্রজাতির না। Computerised Tomography (CT)-র মাধ্যমে প্রাপ্ত সাপটির কঙ্কালের (skeleton) অঙ্গসংস্থানিক তথ্যের (morphological data) সাথে এযাবৎকালে সংগৃহীত সাপের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করার পর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন এই সাপটি সম্পর্কে তথ্য পূর্বে কখনো রেকর্ড করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রাপ্ত সাপ। হিমাচল প্রদেশের চূড়া উপত্যকায় (Churah vally) এই সাপটি আবিষ্কার হয়েছে তাই সাপটির বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয় Oligodon churahensis. নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের এই গবেষণা পত্রটি Evolutionary Systematics বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞানী মির্জা Mongabay পত্রিকাকে জানান,“এটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক যে ইনস্টাগ্রামে ছবি দেখে খুঁজে পাওয়া গেছে একটি নতুন সাপ যা এতদিন পুরো পৃথিবীর মানুষের কাছে অজানা ছিল।”
“It is quite interesting to note that how an image from Instagram led to the discovery of such a pretty snake that was unknown to the world, ” Mirza told Mongabay.
তিনি আরো বলেন,“নিজের বাড়ির পিছনের দিকে নতুন কোনো প্রজাতি পাওয়ার ঘটনা সম্ভবত আগে কখনো ঘটেনি। মানুষদেরকে নতুন অথবা বিরল কোনো প্রজাতির জীব খোঁজার জন্য জীব বৈচিত্র্য পূর্ণ হটস্পট-এ যেতে হয় কিন্তু কেউ যদি নিজের বাড়িতেই পিছনে খোঁজাখুঁজি করে তবেও সে নতুন প্রজাতির কোনো কিছু পেতে পারে।”
“Exploration of your own backyard may yield species that are perhaps undocumented. Lately, people want to travel to remote biodiversity hotspots to find new or rare species, but if one looks at their own backyard, one may end up finding a new species right there.”
হিমালয়ের পশ্চিম অংশের তুলনায় পূর্ব অংশ অধিক জীব বৈচিত্র্য পূর্ণ। পূর্ব হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা, অনুসন্ধান হয়েছে। সেই তুলনায় হিমালয় পর্বত শ্রেণীর পশ্চিম অংশে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানমূলক গবেষণা খুব একটা হয়নি। দুর্গম গিরি, অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য পশ্চিম হিমালয় অঞ্চলের বৃহৎ অংশ এখনও অনাবিষ্কৃত রয়েছে। এই রকম বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য কোটি কোটি অর্থ খরচ করা হয়। নতুন যে সাপ পাওয়া গেছে তার জন্য খরচ কিছু হয়নি। আর এটা সম্ভব হয়েছে ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে। বহু মানুষ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় অহেতুক অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে অথচ তার পরিবর্তে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় হয় না বা পাওয়া যায় না। তবে এগুলিকে একটু বৈজ্ঞানিক উৎসুক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দেখলে কিছুটা ভালো হতে পারে। নতুন প্রজাতির জীব খোঁজার জন্য পুরো পৃথিবী তন্ন তন্ন না করে খুঁজে কখনো নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আশেপাশে খুঁজলেও পৃথিবীর সামনে অপ্রকাশিত কোনো জীব কখনো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
“বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”
স্ফুলিঙ্গ