পাখি শিকার করতে গিয়ে 'গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস' বই তৈরির ধারণা হয়েছিল
The idea of 'Guinness World Records' book came from bird hunting
কোনো রেকর্ড সৃষ্টিকারী ঘটনার কথা শুনলেই আমাদের মনে আসে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়ের কথা। এই বইতে পৃথিবীর যাবতীয় রেকর্ড নথিভুক্ত করা হয়। এই গিনেস বুক জন্মেরও একটি বেশ মজাদার ইতিহাস রয়েছে। আসলে একবার পাখি শিকার করতে গিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বই তৈরির ধারণা হয়েছিল। সেই গল্পটি তাহলে জেনে নেওয়া যাক।
Guinness World Records (Image source: Wikipedia) |
পাখি শিকারীদের মধ্যে ঝামেলা
আয়ারল্যান্ডের ওয়েক্সফোর্ডে স্লানাই নদীর (North Slob, by the River Slaney in County Wexford, Ireland) আশেপাশে পাখি শিকার করতে গিয়েছিলেন কয়েকজন বিত্তবান ও সমাজের প্রভাবশালী মানুষ। সেদিনটি ছিল ১০ নভেম্বর ১৯৫১, শনিবার। এই শিকারী দলের মধ্যে ছিলেন মদ্যপানীয় বিয়ার প্রস্তুতকারী কোম্পানি গিনেসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিউজ বিয়েভার। তাদের নিশানা থেকে একটি গোল্ডেন প্লোভার ফসকে যায়। এরপর হিউজ বিভেয়ার জানতে চাইলেন, ইউরোপে শিকারযোগ্য সবচেয়ে দ্রুততম পাখি কোনটি? এই প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ বললেন গোল্ডেন প্লোভার সবচেয়ে দ্রুততম। আবার কেউ কেউ উত্তর দিলেন ইউরোপে শিকারের উপযোগী সবচেয়ে দ্রুততম পাখি রেড গ্ৰুস। এই নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি, বাগবিতণ্ডা, ঝগড়া শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত কেউ নির্ভরযোগ্য সঠিক উত্তর দিতে পারলেন না।
সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাসেলব্রিজে নিজের বাড়িতে হিউজ বিভেয়ার বুঝতে পারলেন সঠিক তথ্য সমন্বিত কোনো রেফারেন্স বই না থাকলে দ্রুততম পাখির নাম জানা যাবে না এবং এটি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক হতে থাকবে। তিনি আরও ভাবলেন, এমন আরও অনেক প্রশ্ন আছে যেগুলোর উত্তর অমীমাংসিত থেকে যায়। এমন কোনো বই দরকার যেখানে সঠিক তথ্য দেওয়া থাকবে এই রকম প্রশ্নের। সেই বইয়ে দেওয়া থাকবে পৃথিবীর উচ্চতম, বৃহত্তম, দীর্ঘতম, ক্ষুদ্রতম বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য; তেমনি দেওয়া থাকবে দেশভিত্তিক বৃহত্তম, দীর্ঘতম, প্রাচীনতম, ক্ষুদ্রতম, উচ্চতম সব কিছুর তথ্য; এমনকি পৃথিবীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাড়া জাগানো রেকর্ড সৃষ্টিকারী সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত তথ্য।
এই নিয়ে হিউজ বিভেয়ার একবার কথা বলেন তাঁর কোম্পানির একজন এক্সিকিউটিভ ক্রিস্টোফার চ্যাটাওয়ের সঙ্গে। ক্রিস্টোফার একজন অ্যাথলেটিক ছিলেন। পড়াশুনার শেষে তিনি গিনেস কোম্পানিতে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি হিউজ বিভেয়ারকে বললেন তাঁর বন্ধু দুই যমজ ভাই ম্যাকওয়ার্টার ভাতৃদ্বয়ের কথা। যমজ ভাইদের মধ্যে একজন নরিস ম্যাকওয়ার্টার (Norris McWhirter) ছিলেন অ্যাথলেটিক। অপর ভাই রস ম্যাকওয়ার্টার (Ross McWhirter) পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। দুই ভাই তথ্য-পরিসংখ্যান অনুসন্ধান করতেন। ছোটোবেলা থেকেই দুই জন তথ্য ও পরিসংখ্যান বিষয়ে খুব আগ্ৰহী ছিলেন। ছোটোবেলা থেকে তাঁরা খুব মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ, বিভিন্ন পত্র পত্রিকা পড়তেন পড়তেন। এগুলির মধ্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং পরিসংখ্যান পেলে সেটা তারা লিখে রাখতেন।
Ross & Norris McWhirter (Image source: mcwhirterfoundation.org.uk) |
হিউজ ও ম্যাকওয়ার্টার ভাতৃদ্বয়ের সাক্ষাৎকার
হিউজ বিভেয়ার দুই ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ডাকলেন। তিনি ম্যাকওয়ার্টার ভাইদের বহু প্রশ্ন করলেন বিভিন্ন তথ্য এবং পরিসংখ্যান সংক্রান্ত এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দুই ভাই সম্মিলিত ভাবে সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন। হিউজ বুঝতে পারলেন এই দুই ভাইয়ের তথ্য-পরিসংখ্যান সংক্রান্ত জ্ঞানের পরিধি অনেক বড়ো। তাদের স্মৃতিশক্তি ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। হিউজ খুঁজে পেলেন তাঁর বহু আকাঙ্খিত বই তৈরি করার মানুষদেরকে। গিনেস প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুই ভাইকে দায়িত্ব দেওয়া হল তথ্য এবং পরিসংখ্যান সংক্রান্ত সমস্ত সাড়া জাগানো ঘটনা সমন্বিত একটি বই তৈরি করার।
নরিস এবং রসের কাছে আগে থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ছিল। এছাড়াও তাঁরা বহু মানুষকে চিনতেন যারা এক এক জন এক একটি বিষয়ে অনন্ত তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছেন। কেউ প্রাণী সম্পর্কে, কেউ উদ্ভিদ বিষয়ে, কেউ খেলাধুলা সম্পর্কে, কেউ ভূগোল সম্পর্কে, কেউ আবার ইতিহাস রাজনীতি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বইটির প্রথম প্রকাশের জন্য মাত্র তিন মাস সময় পেয়েছিলেন তাঁরা। বইটিক একদম নির্ভুল তথ্য সমন্বিত করার জন্য দিন রাত অবিরাম পরিশ্রম করে বিভিন্ন তথ্য যাচাই বাছাই করেছিলেন।
গিনেস বুক প্রকাশ
তাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছিল ১৯৫৫ সালের ২৭ আগস্ট শনিবার। সেদিন গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস (The Guinness Book of World Records বা Guinness World Records) প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম বার প্রকাশিত বইয়ে ছবি খুব কম ছিল আর ছবি যা ছিল সেগুলি মূলত প্রাচীনকালের সাদাকালো ছবি। বিভিন্ন ঘটনার পটভূমি সহ বর্ণনা লেখা ছিল খুব সহজ সরল ভাষায়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৯৮ টি। প্রথম বার প্রকাশিত বইটি বর্তমানের বইয়ের তুলনায় অনেকটাই ছোটো ছিল।
প্রথম বারের সংস্করণে ৫০ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল কিন্তু তাদের কাছে বই বিক্রির জন্য প্রথম অর্ডার এসেছিল মাত্র ছয়টি। বই প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত অনেকের মনে সংশয় আসে বইটি বাজারে সফলতা অর্জন করতে পারবে কিনা। তবে কিছুক্ষন পরে ১০০ কপির অর্ডার আসে। এর কিছু সময় পরে ১০০০ কপির অর্ডার আসে। সাধারণ কিছুর মধ্যে মানুষের আগ্ৰহ খুব একটা ভালো থাকে না কিন্তু নতুন কোনো কিছুর মধ্যেই প্রত্যেকের কিছুটা আগ্ৰহ হয়। একই ঘটনা ঘটেছিল গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বইয়ের সাথে। বাজারে সাফল্যের কথা বলতে গেলে বলা যায় সেই বছরই মানে ১৯৫৫ সালের বড়দিন ক্রিসমাসের উৎসবে ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সমস্ত বই ছিল এটি। পরের বছর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গিনেস বইয়ের ৭০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। মাত্র দশ বছরের মধ্যে এই বই পুরো পৃথিবীতে অন্যতম বেস্ট সেলার বই হয়ে উঠেছিল। গিনেস বুক জনপ্রিয় হবার পর বিখ্যাত সংবাদ মাধ্যম বিবিসি একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা করেছিল। ১৯৭২ সালে বিবিসি শুরু করেছিল রেকর্ড ব্রেকার্স (Record Breakers) অনুষ্ঠান। প্রথমে এই টিভি অনুষ্ঠান সিরিজের প্রথম সঞ্চালক ছিলেন রয় ক্যাসেল (Roy Castle)। নরিস এবং রস ম্যাকওয়ার্টার এখানে শিশুদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
গিনেস বুকে নিষিদ্ধ রেকর্ড
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ বর্তমানে কিছু রেকর্ড নথিভুক্ত করা নিষিদ্ধ করেছে। পরিবেশের ক্ষতি করে এমন রেকর্ড যেমন ফানুস ওড়ানো, প্রাণীদের ক্ষতি করে এমন রেকর্ড (যেমন: ভারী কোনো পোষ্যপ্রাণীর রেকর্ড) গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ এখন জায়গা পায় না। মানুষের জীবনের জন্য বিপজ্জনক এমন কোনো রেকর্ড (যেমন: জীবন্ত কবরে থাকা) গিনেস বুকে স্থান পায় না। জীবন ও পরিবেশ বিপন্ন করে গিনেস বুকে নাম তোলার ইচ্ছা ও মানসিকতাকে নিরুৎসাহিত করতে গিনেস বুক কতৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গিনেস বুক জনপ্রিয় হবার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষ চেষ্টা করেছেন পুরোনো কোনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে নিজের নাম গিনেস বইয়ে পাকাপোক্তভাবে লিখিয়ে নিতে। অনেক মানুষের শখ রয়েছে উদ্ভট কোনো রেকর্ড করার। অনেকে সফল হয়েছেন। রেকর্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় পাবার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে গিনেস বুকের জনপ্রিয়তা। সেই সঙ্গে পুরো পৃথিবীতে বৃদ্ধি পেয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বইয়ের বিক্রিও। এখন পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৩৭ টি ভাষায় একশোটি দেশে ১৩ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বই।
গিনেস বুক নিয়ে অনেক কিছুই তো জানা হলো। কিন্তু সেই প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা কী হবে? মানে সেই প্রশ্ন যা থেকেই জন্ম নিয়েছিল গিনেস বুক। হিউজ বিভেয়ারের প্রশ্ন – ইউরোপে শিকারযোগ্য সবচেয়ে দ্রুততম পাখি কোনটি? এর উত্তর না জানলে তো একজন উৎসুক পাঠকের জ্ঞান অসম্পূর্ণ হয়েই থাকবে। তাহলে জেনে নিন – উত্তরটি হবে গোল্ডেন প্লোভার পাখি।