ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শিলালিপি
Importance of inscriptions in history
ইতিহাস রচনার জন্য শিলালিপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান। প্রাচীন ইতিহাস রচনায় শিলালিপির ভূমিকা অপরিসীম। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে শিলালিপি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য। শিলালিপি থেকে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। ভারতের ইতিহাস রচনায় শিলালিপির গুরুত্ব আলোচনা করা হলো। শিলালিপির গুরুত্ব শুধুমাত্র ভারতের ইতিহাস চর্চায় সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বের বহু দেশের ইতিহাস রচনায় শিলালিপির অবদান সবচেয়ে বেশি। প্রত্নতত্ত্ববিদ ‘অলচিন’-এর মতে,"প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান এবং লিখিত উপাদানের মিলিত সহযোগীতায় প্রাচীন ইতিহাসের সম্পূর্ণ ও সঠিক উদ্ঘাটন সম্ভব।"
শিলালিপির গুরুত্ব |
শিলালিপি কী?
পাথরের উপর, পাহাড়ের গায়ে, পর্বত গাত্রে, স্তম্ভের উপর প্রাচীনকালে খোদাই করে লেখা কোনো কিছু সাধারণত শিলালিপি নামে পরিচিত। ভারতে মূলত শিলালিপি, স্তম্ভলিপি, তাম্রলিপি পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন,"Inscriptions, have proved a source of the highest value for re-construction of the political history of ancient India."
শিলালিপির বিশ্বাসযোগ্যতা
ইতিহাস রচনার জন্য বহু সাহিত্যিক উপাদান রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে সাহিত্য বিকৃত হতে থাকে। আবার সাহিত্যে অবাস্তব কল্পনারও প্রাচুর্য থাকে। হিন্দু ধর্মের বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরান; বৌদ্ধ জাতক কথা এগুলো কখনোই ইতিহাস গ্ৰন্থ না। ধর্মগ্ৰন্থকে কখোনোই ঐতিহাসিক গ্ৰন্থের পর্যায়ে রাখা যায় না। যেকোনো ধর্মগ্ৰন্থ অবৈজ্ঞানিক, পক্ষপাতমূলক তথ্যে ভর্তি। সেই তুলনায় মাটি বা পাথরের গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপিকে বিকৃত করা যায় না। ফলে শিলালিপির বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ বলেছেন,"প্রশ্নাতীতভাবেই ভারত ইতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য উপাদান হল লিপি।"
ভাষা ও লিপির পার্থক্য
ভাষা ও লিপি কিন্তু একই নয়। প্রথমত ভাষা এবং লিপির মধ্যে সাধারণ পার্থক্য জেনে নেওয়া যাক। মানুষ মুখের মাধ্যমে যা উচ্চারণ করে তা হলো ভাষা। এই ভাষাকে লেখার উপযোগী করার জন্য সাংকেতিক চিহ্ন বা বর্ণমালাকে বলা যায় লিপি। প্রাচীনকালে পাথরের গায়ে লিপি লেখা হতো, এগুলো শিলালিপি।
শিলালিপি কোথায় পাওয়া গেছে?
বিশ্বের বহু দেশে শিলালিপি পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু বিখ্যাত হলো – মিশরের হায়ারোগ্লিফিক শিলালিপি, ভারতের প্রাচীন সম্রাট অশোকের শিলালিপি।
ভারতে প্রাপ্ত শিলালিপি
ভারতে প্রাপ্ত শিলালিপির মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার খননকার্যে উদ্ধার হওয়া লিপি সবচেয়ে প্রাচীন। অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপি হলো – হাতিগুম্ফায় খোদিত কলিঙ্গরাজ খারবেলের শিলালিপি, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর নাসিক প্রশস্তি, দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল প্রশস্তি, কুষাণরাজ কনিষ্কের সম্পট লিপি, গৌড়রাজ শশাঙ্কের গঞ্জাম লিপি, বাংলার পাল বংশীয় রাজা ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রলিপি, দক্ষিণ ভারতের রাজা প্রথম রাজেন্দ্র চোলের তাঞ্জোর লিপি।
ভারতের ইতিহাসে শিলালিপির গুরুত্ব
- রাজনৈতিক ঘটনার ইতিহাস: লিপি থেকে বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক ঘটনা যেমন – সমকালীন রাজার নাম, বংশপরিচয়, শাসনকালের সময়, রাজ্যের বিস্তার ও সীমানা, রাজাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্ৰহ ইত্যাদি জানা যায়। আনুমানিক ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবিকীর্তি বিরচিত আইহোল প্রশস্তিতে, দক্ষিণ ভারতের রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী কর্তৃক উত্তর ভারতের সমকালীন সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসক হর্ষবর্ধনের পরাজয়ের কথা জানতে পারা যায়। হাথিগুম্ফা শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, চেত রাজবংশের কলিঙ্গাধিপতি মহারাজ মহামেঘবাহন খারবেল পনেরো বছর বয়সে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত হন এবং চব্বিশ বছর বয়সে সিংহাসনলাভ করেন।
- শাসননীতির পরিচয়: লিপিতে উৎকীর্ণ তথ্য থেকে রাজার শাসননীতি, শাসনসংস্কার সম্পর্কে জানা যায়। যেমন - সম্রাট অশোকের শিলালিপি থেকে তাঁর প্রজাকল্যাণমূলক বহু কাজের বিবরণ পাওয়া যায়। অধ্যাপক র্যাপসনের মতে,প্রাচীন লিপি একটি দেশ ও যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন,"প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে লিপি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"
সম্রাট অশোকের সারনাথের স্তূপে প্রাপ্ত লিপি (Image source: Wikipedia) |
- বৈদেশিক সম্পর্কের ধারণা: বিদেশে প্রাপ্ত লিপিগুলি থেকে ভারতের সঙ্গে সেই দেশগুলির রাজনৈতিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের বিষয় জানা যায়। ভারতের সঙ্গে পারস্য, মলয় দ্বীপপুঞ্জ, ইউরোপ, চীনের যোগাযোগের কথা জানা যায়। ইরানের বেহিস্তান, পার্সিপোলিস-এ প্রাপ্ত নক্স-ই-রুস্তম লিপি থেকে ভারত ও ইরানের প্রাচীনকালে যোগাযোগ সংক্রান্ত মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেছে।
- অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয়: শিলালিপিতে তথ্য থেকে প্রাচীনকালের বিভিন্ন রাজ্যের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, অর্থনীতির ধারণা পাওয়া যায়। তাম্রফলকে উৎকীর্ণ ভূমিদানপত্রগুলি থেকে ভূমি-সংক্রান্ত আইনকানুন ও ভূমিব্যবস্থার কথা জানা যায়। যেমন – গুপ্তকালীন ও দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন রাজাদের সময়ের তামার পাতগুলিতে খোদিত ভূমিদান বিষয়ক লিপিগুলি থেকে সেই সময়ে সেই রাজ্যগুলির অর্থনীতি ও প্রজাদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।
- ধর্মবিশ্বাসের পরিচয়: শিলালিপিতে খোদিত লেখা থেকে প্রাচীন ভারতের মানুষদের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে জানা যায়। বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরা মনে করে প্রাচীন ভারতে হিন্দু ধর্ম প্রধান ছিল। অনেকে এটাকে সনাতন বৈদিক ধর্ম বলে। অথচ ভারতের মাটিতে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলি স্পষ্ট প্রমাণ করে প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ ধম্মের প্রাধান্য ছিল। ভারতবর্ষ কোনো কালেই ভাববাদী আধ্যাত্মবাদী দেশ ছিল না। ভারতে সবসময়ই কাল অনুযায়ী যুক্তিবাদী দর্শনের জন্ম হয়েছে। ভারতে নাস্তিক্যবাদী চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, বৈশেষিক দর্শন প্রধান ছিল।
সম্রাট অশোক দ্বারা খোদিত লুম্বিনীর লিপি (Image source: Wikipedia) |
- ভাষাচর্চার ধারণা: শিলালিপিতে ব্যবহার করা লিপি ও ভাষা থেকে প্রাচীনকালে প্রচলিত ভাষা ও সমকালীন ব্যবহৃত লিপি সম্পর্কে জানা যায়। ধর্মবিশ্বাসের মতো ভাষা এবং লিপি সম্পর্কেও বর্তমানে মানুষের ভুল ধারণা রয়েছে। অধিকাংশ মানুষ মনে করে ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা সংস্কৃত এবং সংস্কৃত লেখার জন্য সবচেয়ে প্রাচীন লিপি দেবনাগরী লিপি। কিন্তু ভারতে প্রাপ্ত বেশিরভাগ শিলালিপি পালি ভাষায় লেখা এবং পালি ভাষা লেখার জন্য ধম্মলিপি ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে অনেকেই ধম্মলিপিকে ভুল করে ব্রাহ্মীলিপি ভাবে। ধম্মলিপি ছাড়াও খরোষ্ঠী লিপি পাওয়া যায়। এটি ডান দিক থেকে বাম দিকে লেখা হতো। ভারত ছাড়াও চীনের জিনজিয়াং-এও খরোষ্ঠী লিপি পাওয়া গেছে। লিপি ও ভাষার বিবর্তনের ক্রম ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা করলে প্রমাণিত হয় ধম্মলিপি থেকে বর্তমান সময়ের দেবনাগরী লিপির উৎপত্তি হয়েছে এবং পালি ভাষা বহুবার সংস্করণের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে সংস্কৃত ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভারতে প্রাপ্ত শিলালিপির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত লিপিগুলি যার পাঠোদ্ধার এখনো হয়নি।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে লিপিই শ্রেষ্ঠ। ইতিহাসবিদ ফ্লিট বলেছেন,"সাহিত্য, স্থাপত্য-ভাস্কর্য, মুদ্রা প্রভৃতি থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, তার সত্যতা নির্ণয়ে লিপিগুলি যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে।" শিলালিপিকে বলা যেতে পারে ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।