ন্যানো টেকনোলজি যেভাবে বদলে দিতে পারে আগামী পৃথিবী
Nano technology will change the future world
কয়েক বছর আগে যখন আপনি হয়তো সুইচ টিপা ছোটো ফোন (feature mobile) ব্যবহার করতেন। তখন কি আপনি ভেবেছিলেন যে একদিন এমন মোবাইল পাওয়া যাবে যার কোনো হাতে টেপা সুইচ থাকবে না, সব কিছু স্ক্রিনে আঙুলের ছোঁয়ায় হবে। এই স্ক্রিন টাচ স্মার্টফোন (screen touch smart phone) প্রযুক্তি সম্ভব হয়েছে ন্যানো টেকনোলজির (nano technology) সহায়তায়। এটাতো সাধারণ একটি উদাহরণ, ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে আগামী পৃথিবীতে এমন সব যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে চলেছে যা ভবিষ্যত পৃথিবীর চিত্রটাই বদলে দিতে পারে। ন্যানো যার আপাত অর্থ খুবই ক্ষুদ্র কিন্তু এর মাধ্যমেই পৃথিবীতে বিজ্ঞান, গবেষণা, শিল্প ক্ষেত্রে বৃহৎ পরিবর্তন আসতে পারে।
Nanotechnology (symbolic image) (source: Pixabay) |
Nano শব্দের মাধ্যমে কী বোঝায়?
Nano শব্দটি গ্ৰিক Nanos শব্দ থেকে এসেছে যার অভিধানিক অর্থ যাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্রাকৃতি মানুষ বা বামন। বিজ্ঞানে ন্যানো মিটার একটি মৌলিক একক যা ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের পরিমাপে ব্যবহৃত হয়। ১ ন্যানো মিটার বলতে বোঝায় ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ দৈর্ঘ্য। 1nm=10-9m
ন্যানো টেকনোলজি কী?
ন্যানো টেকনোলজি হল বিজ্ঞানের সেই শাখা যেখানে পদার্থের আণবিক, পারমাণবিক স্তরে গবেষণা হয়। 1nm থেকে 100nm সীমার আণবিক বা পারমাণবিক স্কেলের মধ্যে বিভিন্ন ডিভাইস উদ্ভাবনে যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয়, তাকেই সাধারণ ভাবে ন্যানো প্রযুক্তি বলা যায়। 1nm থেকে 100nm range ন্যানোস্কোপিক জগৎ (nanoscopic world) হিসেবে পরিচিত।
ন্যানো টেকনোলজির ইতিহাস
১৯৫৯ সালের ২৯ জানুয়ারী আমেরিকার বিশ্ব বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান (Richard Feynman) ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে (California Institute of Technology) অনুষ্ঠিত আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির (American Physical Society) এক সভায় 'There’s Plenty of Room at the Bottom' আলোচনায় সর্বপ্রথম ন্যানো টেকনোলজির ধারণা দিয়েছিলেন। প্রকৃতিতে এই রকম প্রযুক্তি বহু দিন থেকেই দেখা যায়। জল কখনও কচুপাতাকে স্পর্শ করতে পারে না, কচুপাতার উপর দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে যায়। এটা সম্ভব হয় কচুপাতার পৃষ্ঠে ক্ষুদ্র ন্যানো স্কেলের গঠনের জন্য। ন্যানো টেকনোলজি সম্পর্কে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক চিন্তার জন্য রিচার্ড ফাইনম্যানকে ন্যানো প্রযুক্তিবিদ্যার জনক বলা হয়।
ন্যানোস্কোপিক জগতের পরিমাপ সম্পর্কে ধারণা
সাধারণত মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিছু নিরীক্ষণ করা হয়। যেমন: কোশ, পাতার বিন্যাস, তুলনামূলক বড়ো আকারের ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি। ন্যানোস্কোপিক জগত এর চেয়েও ছোটো। একটি চুলের ব্যাসের ৮০ হাজার ভাগের একভাগ অংশের আয়তনে ন্যানো টেকনোলজি কাজ করে। ন্যানোস্কোপিক জগত কতটা ক্ষুদ্র তা বোঝার জন্য কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। জলের অনুকে ১ ন্যানোমিটার ধরে তাকে ১০ কোটি গুণ বড়ো করলে একটি ক্রিকেট বলের সমান হবে। একটা সরষার বীজকে এক ন্যানো মিটার ধরলে, একটি ফুটবল হবে পৃথিবীর সমান।
ন্যানো টেকনোলজির বর্তমান ব্যবহার
আমরা এখন ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি বহু জিনিস ব্যবহার করছি।
- ল্যাপটপ, কম্পিউটার অথবা সারাক্ষণ হাতে থাকা স্মার্টফোনের প্রযুক্তির উন্নতি ঘটেছে ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে। কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক, মেমরি সব তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজি দরকার।
- ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে পদার্থের অণু-পরমাণুর গঠন, বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষণা করা হচ্ছে।
Nanotechnology (symbolic image) (source: Pixabay) |
- কয়েক দশক আগের বৃহদাকৃতির কম্পিউটার থেকে বর্তমান সময়ের ছোটো স্মার্টফোন, প্রযুক্তিকে হাতের মুঠোয় বন্দী করা সম্ভব হয়েছে ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে।
- সৌর শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরির প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটেছে অর্ধপরিবাহী এবং ন্যানো টেকনোলজির গবেষণায়।
- এখন চিকিৎসা ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে নির্দিষ্ট অঙ্গের টার্গেটে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া যায় ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে।
ন্যানো টেকনোলজির ভবিষ্যত সম্ভাবনা
ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে তৈরি জিনিসপত্রের ভবিষ্যত সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে ১৯৯৬ সালে রসায়নবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড স্মলি বলেছেন,
"The impact of nanotechnology on the health, wealth and lives of people will be at least the equivalent of the combined influences of microelectronics, medical imaging, computer-aided engineering and man-made polymers in the twentieth centure."
বর্তমানে ন্যানো টেকনোলজি 1nm-100nm range পর্যন্ত কাজ করে। ভবিষ্যতে এটিকে আরও সূক্ষ্ম করে 1nm থেকে 50nm সীমা পর্যন্ত করা হবে। ন্যানো টেকনোলজি পৃথিবীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এতদিন যেগুলো কল্পকাহিনীতে ঘটতো সেগুলো ভবিষ্যতে সম্ভব হতে পারে ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে।
- হতে পারে বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে, এখানে উৎপন্ন বিদ্যুৎ পুরো বাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সংরক্ষণ হচ্ছে মাটিতে বসানো ব্যাটারিতে। তখন হয়তো আমাদের বাড়িতে জলের রিজার্ভারের মতো কারেন্ট রিজার্ভের জন্য উচ্চ ক্যাপাসিটারের ব্যাটারি থাকবে।
- এমন জামা কাপড় তৈরি হবে যাতে ধুলোবালি বসবে না। তখন হয়তো সার্ফ কোম্পানিগুলোকে ব্যাবসা বন্ধ করতে হবে।
- পানীয় জলের যোগান দিন দিন কমে আসছে। ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে সমুদ্রের নোনাজল পানীয় উপযোগী করা যাবে।
- ইলেকট্রিক বর্জ্যের সমস্যার সমাধান করতে পারে ন্যানো প্রযুক্তি।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে ন্যানো প্রযুক্তি। আকারে ছোটো মাইক্রোচিপ রোবটিক্স গবেষণাকে ভবিষ্যতে আরো উন্নত করবে।
- ভবিষ্যতে ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে এমন রং তৈরি করা হবে যা দিয়ে দেওয়ালে রং করার পর দেওয়ালটি ধুলো বালি বিকর্ষণ করে সরিয়ে দিবে।
- এমন কাঁচ তৈরি করা হবে যাতে কাঁচে আঁচড় পড়লে বা সামান্য ভেঙে গেলে নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা এই কাজে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। এই রকম কাঁচ সত্যিই আবিষ্কার হয়েছে। ভবিষ্যতে এর বিপুল ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।
- ভবিষ্যতে খাবারের গুণগত মান বৃদ্ধির গবেষণায় জেনেটিক্সের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠবে ন্যানো টেকনোলজি।
- বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে ডিজেল ছাড়া, দূষণহীন গাড়ি, ইঞ্জিন তৈরি করার।
ন্যানো টেকনোলজির অনেক ভবিষ্যত সম্ভাবনা রয়েছে। সবই নির্ভর করছে গবেষণার অগ্ৰগতির উপর এবং গবেষণা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও মূলধনের অর্থের উপর। যদি ন্যানো টেকনোলজির সম্ভাবনাগুলো সফলতা লাভ করে বাস্তবায়িত হয়, তবে ভবিষ্যতে অবশ্যই এক অন্যরকম নতুন পৃথিবী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।