Mona Lisa was stolen from museum, the thief was caught red handed after two years
বিশ্ব বিখ্যাত মোনালিসা চিত্র (Source: Wikimedia Commons) |
ইউরোপের নবজাগরণ বা রেনেসাঁর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি। তাঁর অঙ্কিত ছবিগুলোর মধ্যে তেলরঙে আঁকা ‘মোনালিসা’ চিত্রশিল্পের এক অমর নিদর্শন। ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের কাছে তিনি এই ছবিটি বিক্রি করেছিলেন। প্রথমে মোনালিসা থাকতো ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদে। ১৭৯৭ সালে ছবিটি প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে জনসাধারণের দেখার জন্য স্থায়ীভাবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
মোনালিসার চিত্রকর লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি (Source: Wikimedia Commons) |
ল্যুভর মিউজিয়ামে কোরাজ্জিওর আঁকা ‘মিস্টিক্যাল ম্যারেজ’ এবং তিশ্যানের ‘অ্যালেগরি অব আলফঁসো দ্য ‘অ্যাভালস’ এই দুটি বিখ্যাত ছবির মাঝে রাখা হয়েছিল মোনালিসাকে। এরপর থেকেই অসংখ্য মানুষ দেখতে এসেছে সেই বিখ্যাত চিত্রটি। ভ্রুহীন চোখ, ঠোঁটে অসম্পূর্ণ হাসির সেই নারী লিসা ডেল জিওকনডোর (Lisa del Giocondo) ছবি মোনালিসাকে দেখতে বহু মানুষ এসেছেন ল্যুভর মিউজিয়ামে। তবে একবার মিউজিয়াম থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল এই বিখ্যাত চিত্রটি। সেটা আজ থেকে প্রায় একশো দশ বছর আগের কথা।
ল্যুভর মিউজিয়ামে মোনালিসা (Image source: Wikipedia) |
মোনালিসাকে পাওয়া যাচ্ছে না
১৯১১ সালের ২১ আগস্ট, সোমবার, সকালে ল্যুভর মিউজিয়ামে যেখানে মোনালিসাকে রাখা ছিল তার সামনে দিয়ে কয়েকজন যাওয়া আসা করেছেন। কেউ কেউ দেখেছেন মোনালিসা তার নিজের স্থানে নেই, কেউ আবার ব্যাপারটা লক্ষ্যই করেননি। যারা মোনালিসার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন তারাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন না। মনে করেছিলেন হয়তো ফ্রেমসহ ছবিটি পরিষ্কার করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, হয়তো ছবিটি কোনো শিল্প প্রর্দশনীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা কোনো শিল্পী ছবি তোলার জন্য নিয়ে গেছেন।
চিত্রশিল্পী লুইস বেরোদ এসেছিলেন ল্যুভর মিউজিয়ামে। তিনি লক্ষ্য করেন মোনালিসা তার নিজের স্থানে নেই। শুধু রয়েছে চারটে পেরেক যেগুলি দিয়ে মোনালিসার ফ্রেমকে দেওয়ালে ধরে রাখা হয়েছিল। তিনি মিউজিয়ামের নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে জানতে চান, মোনালিসা কোথায়? নিরাপত্তারক্ষীরাও বলতে পারলেন না মোনালিসা চিত্রটি কোথায় আছে। তবে তারা শিল্পীকে এটা বলে আশ্বস্ত করতে চাইলেন যে, হয়তো মোনালিসার ছবিটি পরিষ্কার করার জন্য মিউজিয়ামেরই অন্য কোনো ঘরে আছে।
মোনালিসা চুরির পর শুধু ফাঁকা দেওয়াল (Image source: Wikipedia) |
অনেক সময় অতিক্রান্ত হবার পরেও যখন ছবিটি এলো না তখন লুইস বেরোদের সন্দেহ হয়। এরপর নিরাপত্তারক্ষীরা ছবিটি খোঁজা শুরু করেন। কিন্তু সেদিন সারারাত সমগ্র মিউজিয়াম তন্ন তন্ন করে খুঁজার পরেও মোনালিসাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। পরদিন ল্যুভর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানায় মোনালিসার নিখোঁজ হবার ঘটনা।
মোনালিসাকে খুঁজতে শুরু হলো তদন্ত
ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি চুরির খবর পেয়েই ষাট জন গোয়েন্দার একটি বিশেষ দল গঠিত হয়। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। সাত দিনের জন্য মিউজিয়াম বন্ধ করে দেওয়া হলো তল্লাশির সুবিধার জন্য। সেসময় ল্যুভর মিউজিয়ামের প্রধান কিউরেটর থিয়োপেলি হোমলো ছিলেন ছুটিতে। মোনালিসার চুরির খবর প্রকাশিত হতেই তাঁকে দ্রুত প্যারিসে নিয়ে আসা হয় এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এটা অবশ্যই অত্যন্ত দুঃখজনক ছিল কারণ ছবি চুরি হবার ক্ষেত্রে তাঁর গাফিলতি ছিল না কারণ তিনি সেসময় ল্যুভর মিউজিয়ামেই ছিলেন না।
মোনালিসার চুরি হবার খবরটি সমস্ত সংবাদ পত্রিকা খুব গুরুত্বের সঙ্গে লিখেছিল। শুধু ফ্রান্স নয় দেশ-বিদেশের সমস্ত সংবাদ মাধ্যম খবরটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছিল। প্যারিসের পুলিশ মোনালিসার ছবিটির অজস্র কপি সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। ফ্রান্সের সরকার ঘোষণা করে চুরি হওয়া মোনালিসার ছবি যে এনে দিতে পারবে তাকে চল্লিশ হাজার ফ্রাঁ পুরষ্কার দেওয়া হবে। প্যারিস জার্নাল একই কাজের জন্য পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ পুরষ্কার ঘোষণা করে। মোনালিসার চুরির ঘটনাকে পৃথিবীতে শিল্প সংক্রান্ত সবচেয়ে বড়ো অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
মোনালিসা নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। তবে এতোদিন মোনালিসার পরিচিতি ছিল বিশেষত শিল্পী মহলে। এর আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে মোনালিসা খুব একটা পরিচিতি পায়নি। চুরির পর মোনালিসাকে নিয়ে যেভাবে খবর প্রকাশিত হতে থাকে তার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে মোনালিসা সম্পর্কে আগ্ৰহ বৃদ্ধি পায়। সাত দিন পর মিউজিয়াম খোলার পর মোনালিসাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেই ফাঁকা জায়গাটা দেখতে মানুষেরা ভিড় করতে শুরু করে। সমস্ত মানুষের মধ্যে মোনালিসা চিত্র খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এদিকে পুলিশের তদন্ত শুরু হয়। কিছু গুজব, ষড়যন্ত্র তত্ত্বও ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে মনে করে এটা জার্মানির কাজ, মোনালিসাকে চুরি করে ফ্রান্সের জনগণের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে জার্মানি। অনেকে মনে করে মোনালিসাকে চুরি করে চোর হয়তো বিদেশে পালানোর চেষ্টা করবে। চোর যেন কোনো ভাবেই দেশের বাইরে পালাতে না পারে তার জন্য ফ্রান্সের সমস্ত সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পুলিশ মনে করে সাধারণ মানুষের কাজ নেই মোনালিসাকে নিয়ে শুধুমাত্র তাদের ঘরের সৌন্দর্য বর্ধন করা ছাড়া। একজন শিল্পীর কাছে মোনালিসা চিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম, এজন্য পুলিশ সন্দেহ করে শিল্পকলা নিয়ে কাজ করেন বা শিল্পকর্ম নিয়ে আগ্ৰহী কোনো শিল্পীই মোনালিসাকে চুরি করেছেন। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মধ্যে নাম আসে সেসময়ের বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোর। পুলিশ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর স্টুডিওতে তল্লাশি চালিয়েছিল।
পুলিশের সন্দেহের চোখে পড়েছিলেন শিল্পী পাবলো পিকাসো (Image source: Wikipedia) |
সেসময় পাবলো পিকাসো খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন কারণ তাঁর কাছে সত্যিই ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে চুরি হওয়া কিছু ভাস্কর্য শিল্পকর্ম ছিল। আসলে সেই সময় ল্যুভর মিউজিয়ামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটোসাঁটো ছিল না, মিউজিয়াম থেকে কিছু চুরা করা খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না। আগেই চুরি হওয়া কিছু শিল্পকর্ম সেসময় পাবলো পিকাসোর কাছে ছিল। তিনি এতোটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর কাছে থাকা চুরি হওয়া সমস্ত শিল্পকর্ম নদীতে ফেলে দেবার জন্য ভেবেছিলেন।
পুলিশের তদন্তের জালে পড়েছিলেন কবি অ্যাপোলিনেয়ার (Image source: Wikipedia) |
পুলিশের সন্দেহের জালে পড়েছিলেন ফ্রান্সের সেসময়ের একজন বিখ্যাত কবি অ্যাপোলিনেয়ার (Guillaume Apollinaire)। চোরাই মূর্তি কেনার অপরাধে অভিযুক্ত হন কবি অ্যাপোলিনেয়ার এবং তাঁর বন্ধু চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো কারণ পাবলো পিকাসোর স্টুডিওতে তল্লাশি করে যে সমস্ত চোরাই শিল্পকর্ম, মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল সেগুলোর নীচে লেখা ছিল ‘PROPERTY OF THE MUSÉE DU LOUVRE’, অর্থাৎ এইগুলি ল্যুভর মিউজিয়ামের সম্পত্তি। তবে তাঁরা দুজনই বেঁচে যান কারণ তাঁরা সরাসরি চুরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এছাড়া মোনালিসা চুরির অভিযোগেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছিল না। আর সত্যি সত্যিই তাঁরা মোনালিসা চুরি করেননি বা চুরি হওয়া মোনালিসার ছবি কেনেননি। পাবলো পিকাসো এবং অ্যাপোলিনেয়ার তাঁদের কাছে থাকা সমস্ত চোরাই শিল্পকর্ম, মূর্তি প্যারিস জার্নালের অফিসে ফেরত দিয়েছিলেন।
ফিরে পাওয়া গেলো মোনালিসাকে
মোনালিসাকে খুঁজে ফিরে পাওয়ার জন্য দুই বছর ধরে তদন্ত চলছে কিন্তু পুলিশ এখনও চোরের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি। কেউ কেউ আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে ইতালির একজন আর্ট ডিলার আলফ্রোডা গেরি একটি চিঠি পান। চিঠিতে ছিল মোনালিসা বিক্রির প্রস্তাব। মোনালিসা চুরির পর থেকে বেশ কয়েকবার আসল মোনালিসা চিত্র হিসেবে বিক্রি হয়েছে মোনালিসার নকল চিত্র। আলফ্রোডা ভেবেছিলেন হয়তো তাকে ঠকিয়ে নকল ছবি বিক্রি করতে চাইছে কেউ।
আলফ্রোডার কাছে চিঠিটা খুব রহস্যময় ছিল কারণ চিঠির প্রেরকের নাম ছিল 'লিওনার্দো'। মানে, স্বয়ং লিওনার্দো মোনালিসার ছবি বিক্রি করতে চাইছেন। আলফ্রোডা যোগাযোগ করলেন তাঁর বন্ধু তথা ইতালির উফিজি গ্যালারির কিউরেটর জিওভানি পোগির সঙ্গে। তাঁরা মোনালিসার ছবি কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং ক্রেতা হিসেবে সেই চিঠির সূত্র ধরে পৌঁছলেন 'লিওনার্দো' ছদ্মনামের আড়ালে থাকা ভিনসেনজো পেরুগিয়ার কাছে। পেরুগিয়ার কাছে মোনালিসার আসল ছবিটি দেখেই তাঁরা বিস্মিত হন এবং পেরুগিয়ার কথামতো ছবিটির দাম পাঁচ লাখ লিরা দিতে রাজি হয়ে যান।
পেরুগিয়ার বাড়ি থেকে ফিরে এসেই আর দেরি না করে তাঁরা সরাসরি ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। মোনালিসার আসল ছবিসহ হাতেনাতে ধরে পরে মোনালিসার চোর ভিনসেনজো পেরুগিয়া।
মোনালিসাকে খুঁজে পাওয়া গেছে "La Joconde est Retrouvée" ("Mona Lisa is Found"), Le Petit Parisien, 13 December 1913 (Image source: Wikipedia) |
কোর্টে বিচার শুরু হলো। পেরুগিয়া জানালেন কীভাবে তিনি মোনালিসার ছবি চুরি করেছিলেন। ১৯১১ সালের ২০ আগস্ট, রবিবার, তিনি রাত্রে ল্যুভর মিউজিয়ামের মধ্যে লুকিয়ে গিয়েছিলেন। পরদিন সোমবার সকালে ভোরের আলো ফোটার পরেই দেওয়াল থেকে ফ্রেমে আঁটা মোনালিসার ছবিটি নামিয়ে ছিলেন। তারপর ফ্রেম থেকে ছবিটি খুলে কোটের নীচে লুকিয়ে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি।
মোনালিসা চুরির ঘটনার পুনর্নির্মাণ Reconstitution of the theft of Mona Lisa. (Source: Art Journey Paris) |
আদালতে নিজের স্বপক্ষে পেরুগিয়া বলেছিলেন, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্মেছিলেন, ফ্লোরেন্সেই তিনি মোনালিসা ছবিটি অঙ্কন করেছিলেন। তাই মোনালিসা চিত্রকর্ম ইতালির রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হওয়া উচিত। এসময় ভিনসেনজো পেরুগিয়াকে ইতালির বহু মানুষ জাতীয় বীর হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন দেশের সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য। তবে শেষ পর্যন্ত পেরুগিয়ার ১৮ মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল কারণ লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি নিজেই ছবিটি ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের কাছে বিক্রি করেছিলেন চার হাজার সোনার মুদ্রার বিনিময়ে। অনেকেই মনে করেন আসলে প্রথম ফ্রান্সিস খুব কম দামে কিনেছিলেন ছবিটি। খুব সম্ভবত পেরুগিয়া এক বছর পরেই জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
উদ্ধারের পর উফিজি গ্যালারিতে প্রদর্শনীতে মোনালিসা (Image source: Wikipedia) |
পেরুগিয়ার কাছ থেকে ছবিটি উদ্ধার হবার পর দুই সপ্তাহ ইতালির উফিজি গ্যালারিতে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছিল। ১৯১৪ সালের ৪ জানুয়ারী মোনালিসা আবার ফিরে আসে তার নিজের স্থান ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে।