প্রাচীনকালে যেভাবে পিরামিডের উচ্চতা পরিমাপ করা হতো
Measurement of the height of pyramid in ancient times
The Pyramids of Giza and the Great Sphinx (Image source: National Geographic) |
মিশরের সুবিশাল পিরামিডগুলি পৃথিবীর সেরা আশ্চর্যের অন্যতম। মানুষ হাতের কাছে যেই বস্তু পায় সেটাকেই মেপে দেখতে চায়। এবার সেই বস্তুটা যদি হয় মিশরের পিরামিড? যদি কেউ পিরামিডের উচ্চতা মাপতে চায় তাও আবার পিরামিডের উপর না উঠে? তাহলে কীভাবে সম্ভব? এটা সম্ভব করেছিলেন প্রাচীন এক গ্ৰীক পণ্ডিত থেলিস (Thales of Miletus)। তিনি জ্যামিতিক পদ্ধতিতে পিরামিডের উচ্চতা নির্ণয় করতে শিখিয়েছিলেন।
গণিতবিদ থেলিসের পদ্ধতিতে পিরামিডের উচ্চতা নির্ণয়
আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ৬২৬ থেকে খ্রিস্ট পূর্ব ৬২৩ সময়কালের মধ্যে থেলিস গ্ৰিসের মেলেটাস (বর্তমানে তুর্কিতে অবস্থিত) অঞ্চলে জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন। ৭৮ বছর বয়সে আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ৫৪৮ থেকে খ্রিস্ট পূর্ব ৫৪৫-এর মধ্যে এই মহান দার্শনিকের মৃত্যু হয়েছিল। তিনি প্রকৃতির সবরকমের বস্তুকেই সহজে পরিমাপ করতে চেষ্টা করতেন; কোনো বস্তুর আকার, আয়তন নির্ণয় করতে চেষ্টা করতেন।
পিরামিডের চূড়ায় না উঠেও মাটি থেকে তার উচ্চতা মাপার জন্য তিনি এক বিশেষ জ্যামিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। এই উচ্চতা নির্ণয়ের জন্য অবশ্য তাকে সূর্য়রশ্মির উপর নির্ভর করতে হত।
পিরামিডের উচ্চতা নির্ণয়ের জন্য তিনি প্রথমে পিরামিড থেকে কিছু দূরে পিরামিডের ভূমির সমতলে একটি খুঁটির দৈর্ঘ্যের সমান ব্যাসার্ধ নিয়ে মাটিতে একটি বৃত্ত টানলেন। সকালে যখন সূর্য উঠল তখন পিরামিড এবং খুঁটি উভয়েরই ছায়া লম্বা হয়ে পড়ছে। সূর্য যত আকাশের উপরে উঠতে লাগল, ছায়া ক্রমশ ছোট হতে লাগল। এক নির্দিষ্ট সময়ে দেখা গেল খুঁটির শীর্ষবিন্দুর ছায়া বৃত্তের একটি বিন্দুতে এসে মিলেছে।
থ্যালেস এই সময়ই দেখলেন পিরামিডের শীর্ষবিন্দুর ছায়া একটি বিন্দুতে এসে পড়েছে তিনি সেই বিন্দুটি চিহ্নিত করে সেই বিন্দুটি থেকে পিরামিডের ভূমির মধ্যবিন্দু পর্যন্ত দূরত্বটি মেপে ফেললেন। এবং প্রমাণ করে দিলেন এই দূরত্বের মাপটিই হল পিরামিডের উচ্চতা।
বিজ্ঞানী থেলিস কীভাবে পিরামিডের উচ্চতা পরিমাপ করেছিলেন সেই বিষয়টি জ্যামিতির মাধ্যমে বোঝার জন্য একই পদ্ধতিতে একটা লাইট পোস্টের উচ্চতা কীভাবে মাপতে হবে তা দেখা যাক। এখানে সাধারণ জ্যামিতিক পদ্ধতিতে ছবিসহ বিষয়টি খুব সহজে নীচে বোঝানো হল।
কোনো লাইট পোস্টের উচ্চতা নির্ণয়
নীচের চিত্রে একটি লাইট পোস্ট (light post) LP দেখানো হয়েছে। LP-এর উচ্চতা নির্ণয় করতে হবে। লাইট পোস্টের থেকে একটু দূরে ভূমির সমতলে একটি ছোটো খুঁটি AB পোতা হল। B-কে কেন্দ্র করে AB-এর সমান ব্যাসার্ধ নিয়ে মাটিতে একটি বৃত্ত অঙ্কন করা হল।
সকালে সূর্য ওঠার সময় দেখা যাবে লাইট পোস্ট ও খুঁটি উভয়েরই লম্বা ছায়া পড়েছে। সূর্য যত উপরে উঠতে থাকবে ছায়াও তত ছোটো হতে থাকবে। এবার সঠিক সময়ের অপেক্ষার পালা। একসময় দেখা যাবে AB খুঁটির ছায়ার অগ্ৰভাগ অর্থাৎ A বিন্দুর ছায়া বৃত্তের উপর C বিন্দুর সঙ্গে মিলে যাবে। ঠিক এই সময়ে লাইট পোস্টের শীর্ষবিন্দু L-এর ছায়া M বিন্দুতে পড়েছে। এই M বিন্দুটি চিহ্নিত করতে হবে।
এবার M বিন্দু থেকে লাইট পোস্টের পাদদেশে অবস্থিত P বিন্দুর সংযোগকারী সরলরেখা PM-এর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে হবে। M বিন্দু থেকে P বিন্দুর দূরত্বই হল লাইট পোস্টের উচ্চতা।
এখানে সদৃশকোণী ত্রিভুজের বাহুগুলির অনুপাতের সমতার তত্ত্ব প্রয়োগে প্রমাণ করা যায় LP=PM
প্রমাণটি নিম্নরূপ
পৃথিবী থেকে বহুদূর থেকে আগত সূর্যরশ্মি কার্যত সমান্তরাল হয়।
সুতরাং LM || AC; সুতরাং ∠LMP = অনুরূপ ∠ACB
∴ সমকোণী ত্রিভুজ LPM এবং সমকোণী ত্রিভুজ ABC সদৃশকোণী।
AB-এর সমান দৈর্ঘ্যের BC ব্যাসার্ধ নিয়ে বৃত্ত আঁকা হয়েছে তাই সমকোণী ত্রিভুজ ABC-এর AB=BC
∴ ∆ABC একটি সমকোণী সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ।
আবার যেহেতু ∆ABC এবং ∆LPM সদৃশকোণী ত্রিভুজ তাই ∆LPMও একটি সমকোণী সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ।
∴ ∆LPM-এর LP=PM
এভাবে লাইট পোস্টের চূড়ায় না উঠেও মাটিতে দাঁড়িয়ে লাইট পোস্টের উচ্চতা নির্ণয় করা যায়। প্রাচীনকালে গ্ৰীক গণিতজ্ঞ থেলিস এই পদ্ধতিতে একটি লাঠি ও তার ছায়ার দৈর্ঘ্যের অনুপাতের সঙ্গে পিরামিড ও তার ছায়ার দৈর্ঘ্যের অনুপাতের সমতার মাধ্যমে পিরামিডের উচ্চতা নির্ণয় করেছিলেন।
(Image source: pbs.org) |
বিজ্ঞানী থেলিসের এই পদ্ধতির মূল অসুবিধা হল দিনের বেলায় সূর্যের এক বিশেষ অবস্থানের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া পাশাপাশি সমতল ভূমি না হলে ছায়ার সঠিক দৈর্ঘ্য পাওয়া যায় না। তবে সেই সময়ে বিজ্ঞান এমন স্তরে ছিল যে তখন এই বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ ছাড়া অন্য কোনো উন্নত উপায় জানা ছিল না। জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতার উন্নতি ঘটেছে। আজ বিজ্ঞানীরা পিরামিড ছাড়িয়ে বহু দূরের গ্ৰহ নক্ষত্রের দূরত্ব পরিমাপ করতে পারেন পৃথিবীতে বসে থেকেই।
পিরামিডের গঠন শৈলী দেখে আমরা অনেকেই বিস্মিত হই। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে এই প্রাচীন পিরামিডগুলো কয়েক হাজার বছর আগে মানুষের শ্রমেই তৈরি হয়েছিল; কোনো ভিনগ্ৰহী এলিয়েন বা কোনো কাল্পনিক সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা যাদুশক্তিতে পিরামিড তৈরি করেনি। অনবরত জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষই উন্নততর সভ্যতা গড়ে তুলেছে।