বলাইয়ের প্রকৃতি প্রেম ও কাকির মাতৃস্নেহ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোগল্প বলাই
Short story Bolai of Rabindra Nath Tagore is about nature lover Bolai and motherly love of his aunty
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেমিক। মানুষ ও প্রকৃতি যে ভিন্ন নয় তা দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'বলাই' ছোটোগল্পের মাধ্যমে। এই গল্পটির রচনা কাল ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের অগ্ৰহায়ণ মাস। এক শিশুর সঙ্গে প্রকৃতির গাছপালার সম্পর্ক কতো গভীর হতে পারে তা এই গল্পে দেখানো হয়েছে। তার সঙ্গে সন্তানহীন মায়ের মমত্ববোধ তুলে ধরা হয়েছে।
এক বাচ্চা ছেলে বলাই ছোটো থেকেই গাছপালা সম্পর্কে আগ্ৰহী। গাছপালার মূল সুরগুলোই তার মধ্যে প্রবল হয়েছে। সদ্য গজিয়ে ওঠা ছোটো চারাগাছ, বাগানের নাম না জানা কতো অজানা অঙ্কুরিত গাছ সবার কাছেই বলাই যেন আপনজন। শ্রাবণে যখন ঝম্ঝম্ করে বৃষ্টি পড়ে তখন বলাই সমস্ত গা দিয়ে যেন সেই শব্দ শুনতে পায়। বিকেলবেলায় ছাদের উপর গা খুলে বেরিয়ে সোনালী রোদ্দুর সারা শরীরে মাখে। মাঘ মাসের শেষে আমের গাছে মুকুল ধরলে সে নিবিড় আনন্দে ভরে ওঠে, তার মনে ঘন রঙ লাগে ফাল্গুনে পুষ্পিত শালবনের প্রকৃতির মতো। বলাই ঘাসের উপর আনন্দে গড়াগড়ি করে, ঘাড়ে সুরসুরি লেগে খিলখিল করে হেসে ওঠে। প্রকান্ড দেবদারু গাছের ভিতরের মানুষকে যেন দেখতে পায় বলাই। কালের পথে সমস্ত জীবের অগ্ৰগামী গাছ। জীবনের প্রথম লগ্নে গাছ সূর্যের দিকে জোড় হাত তুলে বলেছে,’আমি থাকব, আমি বাঁচব, আমি চিরপথিক, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তহীন প্রাণের বিকাশ তীর্থে যাত্রা করব রৌদ্রে-বাদলে, দিন-রাত্রে।‘ বিশ্বপ্রাণের মূক ধাত্রী অরণ্যের গাছ এখনও যেন বলছে,’আমি থাকব।‘ বিশ্বপ্রাণের এই বাণী যেন বলাই শুনতে পেয়েছে।
কেউ গাছের ফুল তোলে, ওর সমবয়সী ছেলেরা গাছে ঢিল মেরে আমলকী পাড়ে। এগুলো বলাইয়ের পছন্দ না, এজন্য তার মনে মনে কষ্ট হয়। গাছকে আঘাত করলে বলাইয়ের দুঃখ হয় দেখে, ওকে খ্যাপানোর জন্য ওর বন্ধুরা আরও বেশি করে তান্ডব করে বাগানে। ওর সঙ্গীরা বাগানের ভিতর চলার সময় ছড়ি দিয়ে গাছগুলোকে মারতে মারতে চলে, কেউ আবার ফস্ করে বকুল গাছের একটা ডাল ভেঙে দেয়। বলাই তার মনের ব্যাথা কাউকে বলতে পারে না কারণ সে বুঝে গেছে কারও কাছে তার সংকোচের কোনো মানে নেই। যেদিন ঘাসিয়াড়া বাগানে ঘাস কাটতে আসে সেদিন তার সবচেয়ে বিপদের দিন। বাগানের ঘাস, আগাছা, কন্টিকারি গাছ, বেগুনী হলুদ নামহারা ফুল, বেড়ার কাছে কালমেঘ বা অনন্তমূলের ছোটো লতা, পাখিতে খাওয়া নিম ফলের বিচি পড়ে গজিয়ে ওঠা ছোট্ট নিম চারা - সমস্ত নিড়নি দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে নিড়িয়ে ফেলে ঘাসিয়ারা। এগুলো বাগানের শৌখিন গাছ না, তাই বলাই ছাড়া তাদের জন্য ভাববার কেউ নাই; তাদের নালিশ শোনার কেউ নেই। বলাই বুঝতে পেরেছে কিছু কিছু ব্যাথা আছে যেগুলো একমাত্র তার, তার চারপাশের লোকের মধ্যে সেই বেদনার কোনো সাড়া নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Image source: Nobel Foundation archive) |
বলাই তার বয়সী আর পাঁচটা বাচ্চার মতো না, অন্যদের মতো সে বড়ো হয়নি। যখন সে একদম ছোটো, মায়ের কোলের শিশু তখনই তার মা মারা যায়। তার বাবা বিলেতে চলে যায় ইঞ্জিনিয়ারিং শিখতে। কাকা-কাকির কাছেই ছোটো থেকে বড়ো হয়েছে। বেশি কথা বলতে পারে না বলাই তাই তাকে মনে মনে বেশি ভাবতে হয় আর ড্যাবা ড্যাবা চোখ মেলে চেয়ে থাকে। বাগানে সদ্য গজিয়ে ওঠা কচি কচি পাতাগুলো মনে হয় তাকে প্রশ্ন করে 'তোমার নাম কী?’ অথবা ‘তোমার মা কোথায় গেল?’ বলাই মনে মনে উত্তর করে,’আমার মা তো নেই।‘ বলাইয়ের মা না থাকলেও তার কাকিমা তাকে সযত্নে লালন পালন করে। গল্পের কোথাও বলা না থাকলেও আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে বলাইয়ের কাকু-কাকিমা নিঃসন্তান দম্পতি, তাদের নিজেদের সন্তান নাই। বলাই তাদের কাছে সন্তান স্বরূপ।
একদিন বাগানের খোওয়া-দেওয়া রাস্তার মাঝখানে একটা গাছের অঙ্কুর দেখতে পেয়েছিল বলাই। এটা কোন গাছ তা জানে না সে। এরপর থেকে সে প্রতিদিন নিজের হাতে একটু করে জল দিয়েছে, সকাল বিকেল ব্যগ্ৰ হয়ে গাছের বৃদ্ধি দেখেছে। গাছটি বাড়ছেও দ্রুত কিন্তু বলাইয়ের আগ্ৰহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে না। যখন দুই হাত উঁচু হয়েছে গাছটা তখন ওর পত্রসমৃদ্ধি দেখে বলাই ভেবেছে - এ একটা আশ্চর্য গাছ, যেমন শিশুর প্রথম বুদ্ধির আভাস দেখামাত্র মা মনে করে – আশ্চর্য শিশু। বলাই ভেবেছিল তার কাকাকে এই গাছটি দেখিয়ে চমৎকৃত করে দিবে। একদিন কাকা সকালে খবরের কাগজ পড়ছিল, এমন সময় বলাই এসে তার কাকাকে ব্যস্ত করে ধরে নিয়ে গেল বাগানে। সেটা কোন গাছ তা জানার জন্যই সে কাকাকে ডেকে এনেছে। কাকা এই শিমুল গাছ যা এতোদিন বলাইয়ের কাছে নামহীন কোনো গাছ ছিল সেটি মালীকে দিয়ে উপড়ে ফেলার কথা বলে কারণ গাছটি একেবারে রাস্তার মাঝখানে নির্বোধের মতো বেড়ে উঠছে যা কাকার কাছে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ছিল। বলাই তার কাকাকে সেই শিমুল গাছ না কাটার জন্য কাকুতি মিনতি করে। তাতে কোনো কাজ না হলে বলাই কান্নাকাটি করে তার কাকির কাছে আবেদন করে গাছটি বাঁচানোর জন্য। তার কাকির কথায় সেবারের মতো শিমুল গাছটি রক্ষা পায়।
এর পর বারবার কাকার মনে হয়েছে শিমুল গাছটি বড্ড বেশি নির্লজ্জের মতো বড়ো হয়ে চলেছে। একেবারে লম্বা খাড়া হয়ে উঠছে। যে দেখে সেই ভাবে, এটা এখানে কী করতে। এরপর আরও দুই চার বার সেই হতচ্ছাড়া শিমুল গাছের মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব দিয়েছে বলাইয়ের কাকা। প্রতিবারই বলাইয়ের কাকিমা সেই গাছটাকে সন্তানের মতো রক্ষা করেছে। শেষে না পেরে কাকা বলাইকে লোভ দেখালো গোলাপের চারা এনে দেবার, শিমুল গাছটি কেটে বেড়ার ধারে শিমুল গাছের নতুন চারা পুঁতে দেবার। কিন্তু, বলাই কোনোটাতেই রাজি হলো না। কাকিও বলাইয়ের সাথ দিলো। শিমুল গাছের প্রতিই বলাইয়ের সবচেয়ে বেশি স্নেহ।
এমন সময় দশ বছর পর বলাইয়ের বাবা বিলেত থেকে ফিরে এলেন। তাঁর ইচ্ছা একমাত্র সন্তান বলাইকে বিলাতি কায়দায় শিক্ষা দেবেন। এজন্য তিনি বলাইকে প্রথমে নিয়ে গেলেন সিমলায়। সেখান থেকে কিছু দিনের জন্য বাড়িতে এসে বিলেত যাবার কথা। বলাই কাঁদতে কাঁদতে কাকিকে ছেড়ে চলে গেল সিমলায়। বলাইয়ের বাবা যেন কাকির কোল থেকে বলাইকে নিয়ে গেলো, একেবারে যেন নাড়ী ছিঁড়ে। বলাই চলে যাবার পর কাকি গোপনে চোখের জল মোছেন। বলাইয়ের শূন্য শোবার ঘরে তার ছেঁড়া এক পাটি জুতো, রবারের ফাটা গোলা, জানোয়ারের গল্পওয়ালা ছবির বই নাড়েন আর চিন্তা করেন বলাই এখন কতো বড়ো হয়েছে। বলাইয়ের সব স্মৃতি চিহ্ন কাকির সম্বল। তার মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা সবই তো বলাইয়ের জন্য। এভাবে দুই বছর কেটে যায়।
এদিকে শিমুল গাছের বাড়বাড়ন্ত দেখে কাকার আরও রাগ হলো। এতোদিনে শিমুল গাছটার বড়ো বাড় বেড়েছে, এতোদূর অসংগত হয়ে উঠেছে যে এবার কোনো মতেই এই বেয়াদব গাছটাকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নয় কাকা। কাকা গাছটিকে কেটেই দিলো শেষ পর্যন্ত কাকিকে না জানিয়ে। সিমলা থেকে বলাইয়ের বাড়ি ফেরা হলো না, তাকে সরাসরি বিলেতে যেতে হবে বাবার সঙ্গে। বাড়িতে আসতে না পারায় সে তার বন্ধু শিমুল গাছের ছবি সুদূর বিলাতে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক। সে তার কাঁচা হাতে কাকিকে চিঠি লিখলো,"কাকি, আমার সেই শিমুল গাছের একটা ফটোগ্রাফ পাঠিয়ে দাও।" কাকি চিঠি পেয়ে বলাইয়ের কাকাকে চিঠি দেখিয়ে বলল একজন ফটোগ্রাফারকে ডাকতে। কাকা বলল,"সে গাছ তো কাটা হয়ে গেছে।"
বলাইয়ের গাছটি চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেছে কথাটা কাকির মনে খুব আঘাত করল, তার বুকে আজীবনের জন্য ক্ষত করে দিল। দুঃখে বলাইয়ের কাকি দুই দিন অন্ন গ্ৰহণ করল না, তার স্বামীর সাথে অনেক দিন কথা বলেনি। সেই শিমুল গাছটি যে ছিল বলাইয়ের প্রাণের প্রতিরূপ, তারই প্রাণের দোসর।