কারসনভাই পটেল তাঁর মেয়ের নামে তৈরি করেছিলেন নিরমা ডিটারজেন্ট
Karsanbhai Patel named Nirma detergent after the name of his daughter
একসময় ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিটারজেন্ট ছিল নিরমা। আপনাদের অনেকের মনে থাকতে পারে ৯০-এর সময়ের ওয়াশিং পাউডার নিরমা (Washing Powder Nirma ) বিজ্ঞাপন। নিরমা ডিটারজেন্ট তৈরি করেছিলেন কারসনভাই পটেল। রসায়ন বিভাগে পাশ করে তিনি একটি কাপড়ের কারখানায় টেকনেশিয়ানের কাজ করেছিলেন, তারপর ১৯৬৯ সালে গুজরাট সরকারের অধীনে খনিজ সম্পদ বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি বাড়িতে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে কাজ করতেন। একদিন এমনই কাজ করার সময় ডিটারজেন্টের মতো কিছু তিনি তৈরি করেন। তিনি কিছু নোংরা কাপড় পরিষ্কার করে বেশ আশানুরূপ ফল পেলেন।
কারসনভাই পটেল এই ডিটারজেন্টের নাম রেখেছিলেন নিরমা। তিনি এই নামটি রেখেছিলেন তাঁর মেয়ে নিরুপমা পটেলের নামে। কারসনভাইয়ের মেয়ে নিরুপমা মারা গিয়েছিল একটি পথ দুর্ঘটনায়। মেয়ের নামকে স্মরণীয় করে রাখতে ডিটারজেন্টের নাম রাখলেন নিরুপমার বাড়িতে ডাকনাম নিরমা।
কারসনভাই তাঁর তৈরি নিরমা ডিটারজেন্ট বাজারে বিক্রি করতে চাইলেন। এজন্য তিনি মুদিখানার দোকানদারদের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু কোনো দোকানদার তার ডিটারজেন্ট দোকানে বিক্রি করতে চায়নি। কারণ সেসময় কাপড় কাঁচার ডিটারজেন্ট মানেই একমাত্র সার্ফ এক্সেল। সেই সাতের দশকে ভারতের অধিকাংশ পরিবার গরীব বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ছিল। ভারতে কাপড় কাঁচার সার্ফ বা ডিটারজেন্টের বেশি প্রচলন ছিল না। সাধারণ সাবান বা সোডা ব্যবহার করা হতো কাপড় পরিষ্কারক হিসেবে। ধনী মানুষরা ব্যবহার করতো ব্রিটেনের ইউনিলিভার (Unilever) কোম্পানির ভারতীয় শাখা হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের (Hindustan Unilever Limited) সার্ফ এক্সেল।
যাত্রা শুরু করলো নিরমা
কোনো দোকানদার তাদের দোকানে নিরমা রাখতে রাজি না হলেও কারসনভাই আশাহত হলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিরমা বিক্রি করবেন। যেমন ভাবনা তেমন কাজ শুরু। কারসনভাই সাইকেল চালিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিরমা বিক্রি করতে শুরু করলেন। তিনি ক্রেতাদের আশ্বস্ত করতেন ডিটারজেন্ট ভালো না হলে টাকা ফেরতের। তার। এর সঙ্গে তিনি money back guarantee দিতেন। তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা কারা হবে? তিনি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যদের ক্রেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
নিরমার উত্থান
সেসময় হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের সার্ফ এক্সেলের এক কেজি প্যাকেটের দাম ছিল ১৫ টাকা। গরীব, মধ্যবিত্ত মানুষদের সামর্থ্য ছিল না পনের টাকা দিয়ে সার্ফ এক্সেল কেনার। কারসনভাই নিরমা ডিটারজেন্ট পাউডারের এক কেজি প্যাকেটের দাম রেখেছিলেন মাত্র ৩ টাকা। তিন টাকা দিয়ে নিরমা কেনা সাধারণ মানুষের কাছে উপযুক্ত ছিল। এজন্য নিরমা বিক্রি হচ্ছিল ভলোই। আশেপাশের এলাকায় মানুষেরা নিরমা ব্যবহার করছে দেখে এবার কিছু দোকানদার নিজেদের দোকানে নিরমা রাখতে চাইলো।
ধীরে ধীরে আরও দোকানদার নিরমা রাখতে শুরু করে দিল। নিরমার বিক্রি বাড়তে থাকে। নিরমার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি সার্ফ এক্সেলের জন্য খুব একটা ভালো ছিল না। সার্ফের দাম কমাতে চাইলেও সেইসময়ে সার্ফ এক্সেলের দাম কমানো হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সার্ফের দাম কমালেই এতোদিনে সার্ফ এক্সেল বাজারে নিজের যেমন ব্র্যান্ড তৈরি করেছিল, সেই ব্র্যান্ড পরিচিতি নষ্ট হবার সম্ভাবনা ছিল। দাম কমাতে গেলে মানুষেরা সন্দেহ করতো সার্ফ এক্সেলের গুণগত মান নিয়ে। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারতো, এতোদিন তাহলে সার্ফ এক্সেল বেশি দামে সার্ফ বিক্রি করে মানুষদেরকে ঠকিয়েছে? মোট কথা বাজারে একটা খারাপ মনোভাব হতো সার্ফ এক্সেল সম্পর্কে। হিন্দুস্থান ইউনিলিভার তাদের কোম্পানি সম্পর্কে এই রকম negative sentiment কখনো চায়নি। কোম্পানির একটু লোকসান হলেও সার্ফ এক্সেলের দাম কমায়নি হিন্দুস্থান ইউনিলিভার।
একবার কোনো কোম্পানির কোনো প্রোডাক্টের brand value তৈরি হলে সেই পণ্যের দাম কমাতে রাজি হয় না কোম্পানি, এর ফলে কিছু লোকসানও মেনে নেয় কোম্পানিটি। এখনও কিছু দামী কোম্পানি তাদের উৎপাদিত পণ্য ফেরত আসলে বা বিক্রি না হলে সেগুলি নষ্ট করে দেয়, দ্রব্যগুলো পুড়িয়ে দেয় কিন্তু কখনই কম দামে বা discount দিয়ে বিক্রি করতে পাঠায় না। বাজারে exclusivity through scarcity-র মাধ্যমে কোম্পানি তাদের product brand value ধরে রাখতে চায়। একই ঘটনা ঘটেছিল হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের সার্ফ এক্সেলের সঙ্গে। সার্ফ এক্সেলের দাম কমেনি।
এক সময় প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য রাখা সার্ফ এক্সেল তার বাজার হারাতে শুরু করে। নিরমার দ্রুত গতিতে উত্থান ঘটে। ১৯৯০ এর সময়ে ডিটারজেন্ট বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশ অধিকার করে নিয়েছিল নিরমা। তবে নিরমার একটা সমস্যা খুব বড়ো আকার ধারণ করে। সেই সমস্যাটি ছিল credit overload অর্থাৎ বিভিন্ন দোকানদারের কাছে পাওনা টাকা। দোকানদাররা তখন নিরমা বিক্রি করতো কিন্তু যদি কাররসনভাই পটেল তাঁর কোম্পানির লোক পাঠায় দোকানদারের কাছে পাওনা টাকা নেবার জন্য তাহলে দোকানদাররা বিভিন্ন অজুহাতে টাকা দিতো না। এর ফলে বাজারে নিরমা খুব ভালো ভাবে বিক্রি হলেও কারসনভাইয়ের কাছে টাকা পুরো আসতো না, দোকানদাররা বিভিন্ন বাহানা করে টাকা দিতে গড়িমসি করতো।
সমস্যাটা এতো বড়ো হয়ে উঠেছিল যে কারসনভাইয়ের ব্যাবসা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। এর একটি দুর্দান্ত সমাধান করেছিলেন কারসনভাই পটেল। এর জন্য তিনি supply scarce strategy তৈরি করলেন। তিনি পুরো বাজারের সমস্ত দোকান থেকে সব নিরমা প্যাকেট তুলে নিলেন মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই। বাজারে যে নিরমা নাই এটা হয়তো কেউ বুঝতে পারতো না, যদি না কারসনভাই পটেল এর পরের কাজটা করতেন।
নিরমার জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন
এরপর টেলিভিশনে নিরমার সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনটি প্রচারিত হয়। নয়ের দশকের বিখ্যাত সেই বিজ্ঞাপনটি ভারতের বিজ্ঞাপন জগতে অন্যতম সফল বিজ্ঞাপন ছিল। ভিডিও এবং গানের জন্য সেই বিজ্ঞাপনটা জনমানসে আলোড়ন তোলে।
वॉशिंग पाउडर निरमा
दूध सी सफेदी निरमा से आए
रंगीन कपड़ा भी खिल खिल जाए
গানে ব্যবহৃত লাইনগুলো বিজ্ঞাপনটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। রাতারাতি নিরমার জনপ্রিয়তা যেন শীর্ষে উঠেছিল। এর পরপরই সবাই নিরমা কিনতে চাইলো। ফলস্বরূপ দোকানদারদের উপর ক্রেতাদের চাপ বাড়তে লাগলো নিরমা কেনার জন্য। কিন্তু বাজারে তো আসলে নিরমা নাই। বাজার থেকে নিরমা তুলে নেওয়া থেকে টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচার সবই এক সপ্তাহের মধ্যে হয়েছিল। দোকানদাররা এবার যোগাযোগ করলো কারসনভাই পটেলের সঙ্গে। কারসনভাই এবার পুরোপুরি নিজের শর্ত বলে রাখলেন - কোনো দোকানদার যেন টাকা মেটানোর ক্ষেত্রে কোনোরকম টালবাহানা না করে। দোকানদাররা কারসনভাইয়ের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য ছিল। এরপর থেকে যারা টাকা মেটাতে দেরি করতো এতোদিন, তারাও সঠিক সময়ে টাকা দিতে লাগলো। নিরমা এর পরে সাবান তৈরি করেছিল। এটিও খুব সফল ছিল বাজারে। সার্ফ এক্সেলকে বহু পিছনে ফেলে দেয় নিরমা। একসময়ে ধনী থেকে দরিদ্র কমবেশি সকলেই নিরমা ব্যবহার করতো।
যেভাবে পিছনে গেলো নিরমা
এবার প্রশ্ন হলো যেই নিরমা একসময় পুরো ভারতের ডিটারজেন্ট বাজারে ৬০ শতাংশ অধিকার করে রেখেছিল সেই নিরমা এখন কোথায় গেল? এখন নিরমা ৬ শতাংশেরও কম অংশ ধরে রাখতে পেরেছে বাজারের। কীভাবে পিছিয়ে পড়লো নিরমা?
কারসনভাই পটেল নিরমা তৈরি করেছিলেন মূলত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সময়ের মধ্যে ভারতের মানুষের দারিদ্রতা অনেকটা ঠিক কমেছিল। এতোদিনে মানুষের মধ্যে একটা মনোভাব তৈরি হয়েছিল নিরমা খুব সস্তা, অথচ সার্ফ এক্সেল এখনও দামি ও ধনী মানুষের জন্য এমন একটা মনোভাব ছিল। নিরমা প্রোডাক্টের কোনো উন্নতি করেনি। নিরমার প্যাকেট ছিল খুব সাধারণ, অন্যদিকে সার্ফ এক্সেলের প্যাকেট ছিল আকর্ষণীয় যা দেখে গুণগত মানে প্রিমিয়াম প্রোডাক্ট মনে হবে। দারিদ্রতা কমার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি হয়েছিল। শুধুমাত্র কম দামি হিসেবে আর মানুষের মন জয় করতে পারেনি নিরমা। বহু মানুষ নিরমা বাদ দিয়ে এখন সার্ফ এক্সেল কিনতে শুরু করে। এতোদিনে আরও কিছু ডিটারজেন্ট বাজারে চলে এসেছিল। প্রতিযোগিতায় না পেরে নিরমা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে।
নিরমা একাধিক ব্যাবসায় ঢুকে পড়ে। ডিটারজেন্ট, সাবান পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু নিরমা পরবর্তী সময়ে লবন, সোডা অ্যাশ, অ্যাসিড, গ্লিসারিন তৈরি শুরু করে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও ঢুকে পড়ে নিরমা। গুজরাটে নিরমা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়। একের পর এক সিমেন্ট তৈরির প্ল্যান্ট অধিগ্ৰহণ করে নিরমা। এতোগুলো ব্যাবসার মাঝে নিরমা ডিটারজেন্ট ব্যাবসায় নজর দিতে পারেনি, প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পৃথক করে দেখাশোনা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন ব্যাবসায় ঢুকার ফলে কারসনভাই পটেলের সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু নিরমা ডিটারজেন্ট প্রায় হারিয়ে গেছে।
নিরমার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এক পিতার তার মেয়ের প্রতি ভালোবাসা। এক জন সাধারণ মানুষ থেকে ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপতি হবার দৌড়ের সাক্ষী নিরমা। অনেকের কাছে নিরমার পুরোনো বিজ্ঞাপনগুলো আজও নষ্টালজিক। নিরমার সঙ্গে অনেকেরই ছোটোবেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। নিরমার স্মৃতির মধ্যেই বহু মানুষের স্মৃতিতেই বেঁচে থাকবে কারসনভাই পটেলের সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়েটি নিরুপমা পটেল।